বুকে লেখা ''স্বৈরাচার নিপাত যাক'' আর পিঠে লেখা ''গণতন্ত্র মুক্তি পাক''- একজন তরুণ ঢাকায় সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচীতে গিয়ে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে পুলিশ-বিডিআরের (বিডিআর-এর পরিবর্তিত নাম এখন বিজিবি) গুলিতে নিহত হন।
সেইদিন পুলিশের গুলিতে আরও দুইজন নিহত হয়েছিল। কিন্তু শরীরে গণতন্ত্রের বার্তা লেখা এই যুবক গুলিতে নিহত হওয়ার পর সামরিক শাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন।
১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর যখন নূর হোসেন পুলিশ-বিডিআরের গুলিতে নিহত হন, তখনকার সংবাদপত্রে সেই ঘটনা ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছিল। এরপরের কয়েকদিন জুড়ে ঢাকায় বিক্ষোভ-সংঘর্ষ চলতে থাকে।
সেই সময়ে এরশাদ সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদ তার 'চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা:১৯৮৩-১৯৯০' গ্রন্থে ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর তারিখের আন্দোলন, গুলিতে হতাহতের কথা উল্লেখ করলেও সেখানে নূর হোসেনের প্রসঙ্গে কিছু লেখেননি।
মি. আহমেদ লিখেছেন, ১৯৮৭ সালের অক্টোবর নাগাদ আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে।....এমতাবস্থায় দুই প্রধান রাজনৈতিক জোট একটি যুক্ত ঘোষণার মাধ্যমে ১০ নভেম্বর রাজধানীতে ১০ লাখ লোকের এক বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ ঘটানোর ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ করে।....এরশাদ এবং তাঁর সরকার এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়। ''
সেই সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে মওদুদ আহমেদ তার বইতে লিখেছেন, ''বিরোধী দলসমুহের এই কর্মসূচীকে প্রতিহত করার জন্য সরকার দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে জনসমাবেশ ও মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের আটক করা হয়, গ্রামাঞ্চল থেকে লোকজন যাতে শহরের দিকে আসতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে লঞ্চ ও ট্রেনের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয় ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নিয়মিত আইন রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিডিআর মোতায়েন করা হয়।''
''সরকারের গৃহীত এসব পদক্ষেপ বানচাল করার জন্য বিরোধী দলগুলো পর্যাপ্ত জনসমর্থন সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জনসভাটি অন্য জনসভার চেয়ে আকারে বড় হলেও তেন কোন সফলতা অর্জন করতে পারেনি।''
''এভাবে ১০ নভেম্বর সরকার বিরোধী আন্দোলন সরকারের দৃষ্টিতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের তীব্রতা কমেনি, বরং ক্রমশ তা ঘনীভূত হতে থাকে।'' লিখেছেন মওদুদ আহমেদ।
কিন্তু বইয়ের কোথাও নূর হোসেনের উল্লেখ করেননি তখনকার উপ-প্রধানমন্ত্রী, পরবর্তীতে এরশাদর সরকারের প্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমেদ। এ থেকে বোঝা যায়, নূর হোসেনের মৃত্যুর বিষয়টি সরকারের ওপর মহল ততোটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি।
এরশাদ সরকারে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''সেই মৃত্যু নিয়ে তখনো সরকারের ওপর মহলে কোন আলোচনা হয়নি, পরবর্তীতেও হয়নি। সরকারে বা দলের মধ্যে এ নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি।''
''তৎকালীন বিরোধী দলের সঙ্গে একপ্রকার আলোচনা হয়েছিল যে, তারা মিছিল নিয়ে এসে চলে যাবেন। কিন্তু তারা এসে একটা অবস্থান নিয়ে নিয়েছিলেন। তখন পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। নূর হোসেন কোথা থেকে আসলো, আমার জানা নেই।''
এ নিয়ে তখনকার মন্ত্রিসভায় বা দলে কখনো কোন আলোচনা হয়নি, বলে বলছেন মি. মঞ্জু।
সেই সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান আর উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (বর্তমানে বিএনপি নেতা), যারা এই বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, এরশাদের সময়কাল বইয়ে ড. মোহাম্মদ হাননান লিখেছেন, নূর হোসেন নিহত হওয়ার পরের দিন, ১১ নভেম্বর (১৯৮৭) ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে এক জনসভায় জেনারেল এরশাদ তার পরিবর্তে বিরোধী দলের নেতাদেরই পদত্যাগ করার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন: ''১০ নভেম্বর বিরোধী দল ৫০ লাখ লোকের ঢাকা সমাবেশ করবে বলে পরিকল্পনা করছিল, কিন্তু তারা ৫ হাজার লোকও আনতে পারেনি।''
তখনকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রেসনোটে বিরোধীদের দেখামাত্র গুলি কারর কথা বলা হয়। ১২ নভেম্বর সংঘর্ষে একজন পুলিশসহ দুইজন নিহত হন।
১০ই নভেম্বরের ঘটনা সম্পর্কে সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়, ''আন্দোলনের নামে পরিচালিত ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় বিপন্ন হয়ে পড়া জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করতে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।''
''শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনজীবনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। সরকার আশা করেন যে, সংশ্লিষ্ট সকল মহল ভবিষ্যতে এ ধরণের কর্মতৎপরতা হতে বিরত থাকবেন'', উল্লেখ করা হয় ওই প্রেসনোটে।
অবশ্য নূর হোসেনের মৃত্যুর পরবর্তী কয়েকদিন পর্যন্ত তার নাম ততোটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি। বুকে-পিঠে গণতন্ত্রের বাক্য লেখা থাকলেও অনেকেই তার নাম জানতেন না। সেইদিন নূর হোসেনের পাশাপাশি পুলিশের গুলিতে আরো দুইজন কর্মীও নিহত হয়েছিলেন।
তবে বুকে পিঠে গণতন্ত্রের বাক্য লেখা নূর হোসেনের কয়েকটি ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে নূর হোসেন সামরিক শাসন বিরোধী গণ-আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
নূর হোসেন নিহত হওয়ার পরের দিন, ১১ই নভেম্বর ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল, "ঢাকায় মিছিল সংঘর্ষ, পুলিশের গুলিতে নিহত ৪"। বাংলাদেশ টাইমসের শিরোনাম ছিল, "থ্রি কিলড, হানড্রেড হার্ট"।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''নূর হোসেনের আগে ও পরেও আরও অনেকেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। কিন্তু এসব মৃত্যু নিয়ে তখনকার সরকার বা দলের মধ্যে কোন মাথাব্যথা ছিল বলে দেখা যায়নি। একদিকে আন্দোলন চলেছে, আরেকদিকে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ-সহিংসতায় হয়েছে। নূর হোসেনের মৃত্যু নিয়েও ক্ষমতায় থাকার সময় জাতীয় পার্টি বা এরশাদ সরকারের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।''
''তবে এরপর যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তারই ফলশ্রুতিতে কয়েক সপ্তাহ পর ৬ই ডিসেম্বর এরশাদ পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হন। এবং আন্দোলনের পরবর্তী ধারাবাহিকতায় তার পতনও ঘটে।'' তিনি বলছেন।
তিনি জানান, তবে ১৯৯৬ সালে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।